একটি প্রেমের গল্পঃ নিঃসঙ্গ মেষপালক

১.
সময় খুব দ্রুত চলে যেতে থাকে। হৃদপিন্ড বের আসতে চাইছে। বুকের ভেতর অবিরাম হাতুড়ির কড়া নাড়া চলছেই। সি এন জি টাকে একটু দূরে থেকেই ছেড়ে দেয় অনিক। জায়গাটা তার বেশ পরিচিত। অনেকগুলো বছর সে এই জায়গায় রাতে হেটে বেড়াত। রাতে একা হাটতে ভালো লাগত খুব। এখন কিছুই আগের মত নেই, আসলে কখনো থাকেনা। মানুষ মূলত একা তবু যে কেনো পাশে কাউকে চায়, বোকামি বড় বেশি বোকামি। একটা চায়ের দোকানের পাশে গিয়ে দাড়ায় অনিক। দুজন লোক বসে আছে এত রাতেও। ট্রাকের হেল্পার হতে পারে। চুপচাপ বসে পড়ে সে। ডান হাতটা তখনো কাঁপছে। ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। হাতে কি এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে?

মামা, চা কোনটা দিমু? ইশপিশাল?
না নরমাল দাও।
মামা মন দিল খারাপ নাকি?
নাহ খারাপ কেন হবে?
নাহ দেখে মনে হইতাছে
ওহ! (বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে অনিকের, তাকে দেখতে কি ভয়ানক লাগছে?) নাহ মামা শরীর তা যেন কেমন লাগছে এই আর কি
মামা, মাল লাগবো নাকি? কচি আছে। আপনার লাইগা রেট কম (মুচকি হেসে ফেলে পাশে বসা লোকটা)
আরে কি বল এইসব (রেগে যায় অনিক, পরমুহুর্তে মনে হয় রেগে যাওয়া উচিত হবেনা )। নাহ মামা অন্য কোন একদিন
মামা আজই যান, শইল ভালা ঠেকবে দেখবেন। ওই মামারে ভিত্রে লইয়া যা।
অন্ধকারে মেয়ের মুখ দেখা যাচ্ছেনা, দেখতে ইচ্ছে করে।
তোমার নাম কি?
কমলা
আসল নাম কি?
আসল নাম দিয়া করবেন? ট্যাকা বেশি দিবেন?
ঘরে ঢুকে যায় তারা। বেড়া আর পলিথিনের ঘর। তার মাঝে কিছু জায়গায় বড় বড় ফাঁকা। রাস্তার হালকা আলো ঢুকে সেখান দিয়ে। কিন্তু মেয়েটার মুখ দেখা যায়না। কমলা এক ঝটকায় কাপড় খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ে। হঠাত বেড়ার ফাঁক দিয়ে ট্রাকের আলো এসে পড়ে কমলার মুখে। কমলার গলা চেপে ধরে ফেলে অনিক। কমলা চিৎকার করে। আরও জোরে গলা চেপে ধরে অনিক। মেয়েটা ধাক্কা দিয়ে অনিককে ফেলে দেয়। চা দোকানদার সহ আরও দুজন তখন ঘরের মধ্যে।
ওই কি অইছে?
শালার ব্যাটা চুদতে জানেনা চুদতে আইছে, আমার গলা টিপ্যা ধরছে ঢ্যামনা মাগীর পুলা
অনিক উঠে দাঁড়াতে পারনা। দোকানদার তাকে টেনে তুলে। মামার শইল মনে হয় বেশী খারাপ।
মামারে ঘরে নিয়া যাই?
চলেন
দোকানদারের কাঁধে ভোর দিয়ে অনিক ঢুকে যায় একটা দোতলা পুরনো বাড়িতে।
মাঝে মাঝেই দু একজন উঁকি দিয়ে যায়। ঘরটা কেমন গুমোট, স্যাঁতস্যাঁতে। ফিনাইল এর গন্ধে নাক জ্বালাপোড়া করছে। মেঝেতে কিছু জন্মনিরোধক এর প্যাকেট। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামে অনিক। দরজাটা একটু খুলে বাইরের দিকে তাকায়। মেয়েগুলোকে খুব চেনা মনে হয়। আরও সামনে যেতে থাকে অনিক। সবাই দেখতে দীপার মত। কেউ দীপার মত হাত নাড়ছে, কেউ হেসে উঠছে। শুধু শরীর গুলো আলাদা। একজন অনিকের দিকে তাকিয়ে দীপার মত হেসে উঠে। অনিক দৌড়ে গিয়ে মেয়েটাকে ধরে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
মামা ভালো আছেন?
চোখ খুলতেই মুখের উপর ঝুলে পড়া একটা মুখ। অচেনা মনে হয়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চিনতে পারার মত একটা হাসি দেয়।
জ্বি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?
আমি তো মামা ভালাই।
মামা আপনারে ভালা জাগায় রাখতে পারলাম না
সমস্যা নাই, আমি ভালো আছি এখানে
অনিকের হঠাত ভয় করতে থাকে।হুট করে লোকটাকে ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসে।
আমি যদি এখানে কিছুদিন থাকে কোন সমস্যা হবে?
কি কন মামা, কোন সমস্যা নাই খালি মাইয়া গুলান থেইকা দূরে থাকবেন তাইলেই অইব।
আচ্ছা।
এইডা কইতাম না, অরা আমারে কইল কাইল আপনি নাকি ওদের দেখে কেমন করেছেন, একজনরে কাছে টাইনা নিয়া আবার গলা চাইপা ধরছিলেন।
আচ্ছা, সরি ভাই ইচ্ছা করে না। যাই হোক আপনি এই চার হাজার টাকা রাখুন। আমার কাছে এইটাই আছে ভাই।
না মামা, ট্যাকা লাগবো না। আর আপনে কিছু খাইয়া নেন। আমি সন্ধ্যায় আহুম। আর মামা, আমার নাম জমির মিয়া। আপনে মনে হয় আমারে ভুইলা গেছেন।
ওহ হ্যাঁ জমির
জ্বি আর আপনি আমারে তুমি করে কইতেন। এখন আমি যাই। সন্ধ্যায় আইতাছি।
২.
জমির চলে যায়। অনিকের মাথায় ঝড় তলে আগেকার গল্প। তুষার আর অনিক সারারাত সোহরাওয়ার্দী পার্কে হাঁটত আর কবিতা পড়তো। তুষার অদ্ভুত বাঁশি বাজাতো। আর অনিক কবিতা পড়তো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেরদিন গুলোও মনে পড়ে খুব। এক থালায় দুজন মিলে ভাত খাওয়া। আরও একজন বন্ধু ছিল সবুজ। কারও কাছেই টাকা ছিলনা তখন। অনিক, তুষার আর সবুজ তিনজনেই দশ টাকা করে নিয়ে যেত, তারপর পাবলিক লাইব্রেরীতে সারাদিন। দুপুরে ১৫ টাকায় ১০ টাকার ভাত আর ৫ টাকার তরকারীতে তিন বন্ধু। আর বাকি ১৫ টাকায় সিগারেট। একবার কোত্থেকে এক লোক এসে তাদের পাশে বসলো। লোকটা নিজ হাতে তাদের প্লেটে তিনটা মাছ, তরকারি আর ভাত দিয়ে দিল। তারপর বিল দিয়ে চলে গেলো। ওরা অনেক খুজেও পায়নি লোকটাকে।
সবুজের ইচ্ছে ছিল থিয়েটার করবে। অনেক কষ্ট করে একটা নাট্যদলে ঢুকেও পড়লো। এখন অবশ্য বিখ্যাত মুখ। একবার ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারলোনা সবুজ টাকার জন্য। অনিক নিজেও অবশ্য পারেনি দুবার। ভেবেছিল আর না, পড়ে তুষারের চাপাচাপিতেই, আর তুষার... মাথার ভেতর খুব যন্ত্রণা হয়।
দ্রুত ব্যাগ খোলে অনিক। একটা টি শার্ট একটা জিন্স। খুব ভালো মত দেখে নেয় কোথাও রক্তের দাগ লেগে আছে কিনা। হঠাত দৌড়ে বাথরুমে যায় অনিক। হাত ধুতে ধুতে ক্লান্ত হয়ে যায় তবু তার মনে হয় রক্তের দাগ যেন শেষ হয়না। দরজায় দুমদাম শব্দ। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারেনা। শব্দের তীব্রতা বেড়েই চলছে। অনিক কি করবে বুঝতে পারেনা। তাহলে কি এখানেই সব শেষ? বাথরুম থেকে বের হতে গিয়া হাত কেটে যায়। ফিনকির মত রক্ত ভিজিয়ে দেয় অনিকের জামা। দরজার ওপাশে শব্দের তীব্রতা বেড়েই চলছে।
কোনমতে দরজা খুলে দেয় অনিক।
ওহ, ভাই আপনি। আমি ভেবেছিলাম...
কি ভাবছিলেন?
কিছুনা
হাত কাটলেন ক্যাম্নে? পরী বিবি স্যাভলন বোতলটা নিয়া আয় তো।পরীবিবি রানীর মত হেলতে দুলতে স্যাভলন আর তুলা দিয়ে যায়। জমির যত্ন করে কাটা জায়গা পরিস্কার করে দেয়।
মামা, আপনে আমারে জমির বইলা ডাইকেন
আচ্ছা
মামা আমি জানি আপনি ঝামেলায় আছেন
কিভাবে বুঝলা?
বুঝা যায় মামা। এইসবের পর এমন হয়
কোনসব?
মামা সব খুইলা বলন ঠিকনা। দেয়ালেরও কান আছে
তোমার কাছে সিগারেট আছে জমির?
মামা আপনার বালিশের পাশেই রাখা আছে দেখেন, আমি সকালেই রাইখা গেছি, আপনার কি অন্য কোন নেশা পানির অভ্যাস আছে? থাকলে কইতে পারেন
না নাই
সিগারেট টা ধরিয়ে চুপচাপ টানতে থাকে অনিক। অল্প আলোয় জমিরের মুখটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে জমির ক্ষমতাধর কেউ । জমিরের চোখ দুটো ভালোমত পড়ার জন্য সিগারেটে জোরে টান দেয় অনিক। আলোটা আরো গাঢ় হয়ে জ্বলে উঠে। জমিরের লাল টকটকে চোখ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে।
কি চায় জমির? কিংবা কে এই জমির?
হঠাত জমির সিগারেট ধরিয়ে অনিকের দিকে তাকায়, আরেকটু কাছে এসে বসে। একটু কাশি দেয়ার চেষ্টা করে।
জমির কি কিছু বলতে চায়? কি বলতে চায়? জমির কি সব জানে? তাহলে এখন কি হবে? সে কি করবে? কিছুই ভাবতে পারেনা অনিক। জমির তার ডান হাতটা অনিকের বুকের দিকে চলে আসে।
৩.
মামা, এই জায়গাটা আমার। আমি গত ৫ বছর ধইরা এইডা চালাইতেছি। আর ৫ বছ আগে আমি এই জায়গায় আইছিলাম কাস্টমার হইয়া।
তারপর মালিক হয়ে গেলা?
মামা এগুলার মালিক কে এটা কেউই জানেনা। তারা দেখা দেয়না। কইতে পারেন আমি ম্যানেজার। মাইয়া আনি, পরীবিবিরে দেই মাগী সব সিস্টেম করে।
মেয়ে কোত্থেকে আনো?
এসব শুইনা কি করবেন, তার চেয়ে আপনেরে একটা ভয়ঙ্কর কথা কই
বল
পরীবিবির আমার বউ হওয়ার কথা আছিল
কি বল এইসব
হ মামা। পরীর লগে আমার দশ বছরের প্রেম আছিল
তারপর?
আমার পড়ালেখা হইলনা। আমি ঢাকায় আইসা পড়লাম, একটা দোকানে কাম নিলাম। পরী তহন কেলাস নাইনে পড়ে।হুম, তারপর?আমি দুই ঈদে বাড়ি যাই, পরীর লগে দেহা করি। কত কি কিনা লইয়া যাইতাম। পরীরে কিছু দিতে পারলে ভালা লাগতো। আর প্রতি মাসে ট্যাকা তো পাঠাইতাম ই। সারাদিন তালতলার পুকুরপাড়ে বইসা থাকতাম। কত গল্প করতাম।
তারপর কি হল?
আমি চাইরদিনের বেশী ছুটি পাইতাম না। প্রথম প্রথম পরী সারাদিন আমার লগে থাকলেও পড়ে দিয়া আর বেশীক্ষণ থাকতে চাইতনা। এমনকি দুই বারের বেশী দেখাও করতোনা। খালি ঈদের আগের দিন দেহা কইরা জামা কাপড় দিতাম আর ঈদের দিন দেখা করত ওই জামা পইড়া।
তো তুমি কি করতা?
গাঞ্জা খাইতাম পুকুরপাড়ে বইয়া বইয়া।
এত আগে থেকে এসব খাও?
মামা কি যে কন, আমাগো ওইহানে এগুলা কোন ব্যাপার না
আচ্ছা
আমার একটা দোস্ত আছিল রইসুদ্দীন, রসু। ওর আর আমার চেন কাটাও একলগে হইছিল। হে হে।
চেন কাটা ব্যাপারটা কি?
মোসলমানি
ওহ আচ্ছা।
ওর লগে বইয়া গাঞ্জা খাইতাম আর দুঃখের কতা কইতাম। পরী বিবি আমার সাথে ঠিক মত কথা কয়না, দেখা দেয়না। তিন বছর পরে ট্যাকা জমাইয়া দুইডা মুবাইল কিনলাম। একটা আমার লাইগা আরেকটা পরীর লাইগা।বাহপরথম পরথম ফোন দিলে আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টা কথা কইত। কিন্তু মাস খানেক যাওনের পরে ফোন দিলে ঠিকমতো ধরেনা, ধরলেও বেশীক্ষণ কথা কয়না। কইত ফোনে চার্জ নাই।
কেন চার্জ দিতে পারতোনা?
না ওদের বাসায় কারেন্ট ছিলনা। তয় যতক্ষন কথা হইত সবি সংসারের আলাপ আর পেম পিরিতি মার্কা কথা। আমাগো পোলার নাম হওনের কথা আছিল সুলতান আর মেয়ে হইলে রানী।বাহ, সুন্দর প্রেম।
পরীবিবি কইত আমারে ছাড়া অন্য কোন পুরুষ হে চিন্তাও করতে পারেনা। আমি একমাত্র পুরুষ যে হেরে ছুইছে, হের শইলে হাত দিছে, আমারে না পাইলে সে গলায় দড়ি দিবে। একবার তো মরার লাইগা বিষ কিন্যা আইনা আমারে ফোন দিছিল।
হাহাহা, তারপর?
আমি ওরে কইলাম রসুর বাড়িতে গিয়া চার্জ দিতে, আমার বাড়িতেও কারেন্ট আছিল না। হে কইল আমি ছাড়া সে অন্য কোন পুরুষের বাসায় যাইবনা। এর লাইগা সারাদিন ময়েজ এর দোকানে চার্জ দিয়া রাইতে নিয়া আইত।
হুম
কিন্তু দিন দিন পরীবিবিরে আমার অচেনা ঠেকে। আমি গেলে দেখা করতে চাতনা, ফোন দিলে কথা বলতে চাইতনা। ফোন দিলে কইত বাসায় নাকি সমস্যা অনেক। হাত ধরতে গেলে কইত বিয়ার আগে হাত ধরন যাইবনা, আর মাথা ব্যাথা, জ্বর এইসব। দেখা করতে যাইতে কইত মাইঝ রাইতে। হের ঘরের পিছনের জানালায়। মাগী বাইর হইতনা, জানালার অইপাশ দিয়া কতা কইত।
তারপর?
একদিন এরকম দেহা করতে গেছি, মাগী জানালার ওইপাশে। হঠাত কইরা মাগীর বুকের কাপড় গেলো পইড়া, দেহি মাগীর বুকে কামড়ের দাগ।
সেকি? কি করলা তখন?
কিছু কইলাম না। পরের দিন ঢাকা আইসা দোকানে একটা পোলা বসাইয়া আবার গেলাম বাড়িতে। ঢাকা আইতাম না, খালি দোকানের লাইগা আইছিলাম। আমার তখন মাথায় রক্ত।
৪.
ব্যাগটা বাসায় রেখেই বেরিয়ে গেলো জমির।
আজই একটা হ্যাস্ত ন্যাস্ত অইয়া যাইতে অইব। হয় আমার একদিন নইলে মাগীর একদিন। ময়েজের দোকানের দিকে হাঁটা দেয় জমির।
জমির‍্যা তুই এই দিনে? কিছু অইছেনি? আর মেলাদিন পরে আমার দোকানে আইলি?
আইছি ঢাকা থিকা, এমনেই আইলাম। তর লগে দেহা করতে।
তাইলে চা- বিড়ি খা
না খামুনা। পরীরে একটু দরকার আছিল।
মাইয়ারে তো এইদিকে দেহিনা মেলাদিন। কয়দিন দেখসিলাম রসু গো চিপায়।
কি কস এইসব? পরী তর দোকানে মোবাইল চার্জ দেয়না?
কোনোদিন না, মাইয়া এইদিকে আহে খালি বাজার কিনতে।
কিছু হইছে?
না হয়নাই, এমনি পরিবির বাসায় গেছিলাম, দেখলাম নাই তাই তরে জিগাইলাম
তুই কি পরীবিবিরে খুজতাছোস?
নাহ, পরীরে খুজিনা। তরে খুজি
খেপস ক্যান, পরীর লগে কাম থাকলে রসুর বাড়ির চিপায় যা, পাইয়া যাইতে পারস। বলেই একটা হাসি দিল ময়েজ।
জমিরের শরীর টা জ্বলে গেলো। মাথায় আগুন ধরে গেলো জমিরের। সোজা হাঁটা দিল রসুর বাসার পেছন দিকে। আস্তে আস্তে পা ফেলে ফেলে যাচ্ছে।
কিন্তু কই কেউ নাই তো। পুরা ফাঁকা বাড়ির পেছনে। হঠাত ভালোমত খেয়াল করে দেখে রসুর ঘরের ভেতর থেকে পরীর গলা শোনা যাচ্ছে। জমির আস্তে আস্তে এগিইয়ে যায়। বেড়ার ভিতরে দিয়ে তাকায়।
বেড়ায় ঝোলানো পরীর জামা দেখেই চিনতে পারে জমির। এই ইদেই দিয়েছিল এটা। বিছানায় তাকাতেই, বিবস্র পরীর উপর ঘামে ভিজে জব্ জবে হয়ে যাওয়া কালো মানুষটা কে চিনতে কষ্ট হয়না জমিরের। রসু, তার ছোট্রবেলার বন্ধু। সবকিছু এলোমেলো মনে হয় জমিরের। দৌড়ে বাড়ির উঠোন থেকে লম্বা দা টা নিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। চোখের পলকে আলাদা হয়ে যায় শরীর থেকে রসুর মাথা। পরীবিবি হঠাত তার কাপড় খুজে পায়না। নগ্ন দেহ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে হাত দিয়ে।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘর। রসুর আলাদা হয়ে যাওয়া মাথাটা তখন কাঁপছে, তার চেয়ে বেশী কাপছে তার শরীর টা। জমির পরীবিবির সামনে যায়, তারপর একদলা থু থু ছুড়ে দিয়ে বের হয়ে আসে। সারা শরীর জুড়ে রক্তাতের দাগ। ধবধবে সাদা শার্ট লাল হয়ে গিয়েছে। তারপর বহুদিন সাদা জামা পড়া হয়নি জমিরের।
৫.
অনিকের দম বন্ধ হয়ে আসে। কি বলবে বুঝতে পারেনা। একটা সিগারেট ধরায়। জমিরও একটা সিগারেট ধরায়। একটা টান দিয়া আবার শুরু করে সে।
ঢাকা আইসা পরথমেই এক বোতল মাল কিনলাম, হেরপর এইহানে। অমানুষের মত নির্যাতন করলাম একটা মাইয়ারে। আধা বোতল মদ খাওয়াইলাম। মাইয়া কত কান্নাকাটি করছিল, ছাড়ি নাই। ছাড়ুম কেন কন? সারারাইতের লাইগা নিছিলাম তো।
তারপর?
হঠাত মাঝরাইতে মাইয়ার মুখের দিকে তাকাইয়া মাথা চক্কর দিয়া উঠলো। দেহি পরীবিবি। গলা টিপ্পা ধরলাম মাগীর। লোকজন ছুইটা আইলো। এক সপ্তাহ পর আবার বাড়িতে গেলাম। পরীরে অনেক কিছু কইয়া বিয়ার জন্যি রাজি করাইলাম। মাইয়ারে লোভ দেহাইতেই অবশ্য রাজি অইয়া গেসিলো, তাছাড়া ভয় ও পাইছিল।
তারপর?
তারপর মাগীরে ঢাকা নিয়া আইলাম, যে রাইতে নিয়া আইলাম সেই রাইতেই মাগীরে বেইচা দিলাম এইহানে। নগদ ৩০ হাজার ট্যাকায়। অবশ্য এইহানে আনার পর কোনোদিন পরীবিবিরে ছুঁইয়াও দেহি নাই। দেন আরেকটা বিড়ি ধরাই।
অনিক কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট এগিয়ে দেয়। জমির সিগারেট ধরিয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।
মামা আমি কিন্তু কোন বে ঈন্সাফি করিনাই। আল্লা নিজেই সবার জায়গা ঠিক কইরা দিছে। আমরা তো খালি হুকুমের দাস। আপনে থাকেন অহন যাই।
উঠে চলে যায় জমির।
৬.
ঘরগুলোতে কোন ভেন্টিলেশনের ব্যাবস্থা নাই। শুধু দরজার দেয়ালের উপরে একটা ইট সরানো। সম্ভবত এইটা খুব একটা কাজে আসেনা। নইলে ঘরের ধোঁয়া কিছুটা হলেও কমতো। তবে ফুটোটা দিয়া ঘরে তীর্যক আলো ঢুকছে। সুর্যের আলো না, হলুদ রঙের টাংস্টেন বাতির আলো। ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে আছে। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। চোখ জ্বালাপোড়া করছে।
অনিক শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছে।
আগের দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে।
অনিক আর দীপা একবার ঘুরতে গিয়াছিল মেঘনায়। নৌকা ভাড়া করে সারা বিকাল ঘুরেছিল। দীপার সাথে পরিচয় হওয়ার আগে ঘুরেছিল অনিক আর তুষার। একই জায়গায়। অনিকের একা একা ভালো লাগতো না। শুধু দিপাকে নিয়ে ঘুরতেও খুব ভালো লাগতো না। মনে হত তুষার একা একা কি করবে। সবকিছু খুব অদ্ভুত লাগে অনিকের।
একবার রাগ করে অনিক বলেছিল যে সে আর থাকবেনা, আর সেই রাতেই দীপা একগাদা ঘুমের ঔষধ খেয়ে হাসপাতালে।
মাঝখানে কিছুদিন পার্টতাইম চাকুরি করত অনিক। দুপুর ২ টা থেকে রাত ৮ টা। ক্যাম্পাস ফিরতে ফিরতে ৯ টা। দীপা হলের সামনে বসে থাকতো। মাত্র আধাঘন্টা বসতে পারতো বলে সেকি মন খারাপ হতো দীপার।
তিনমাস, মাত্র তিনমাসে কতকিছু পাল্টে যায় পৃথিবীতে। অনিকের খুব অসহায় লাগে।
অথচ বাড়ি যাবার আগেও দীপা বলেছিল, আমাকে নিয়ে গেলে হয়না? কিভাবে? তোমাকে ছাড়া?
সময়টাকে খুব অচেনা মনে হয়। দীপা খুব ভালো গান গাইত। একবার বৃষ্টিতে গাইলো-
গোধুলী গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা
আমার যা কথা ছিল বলবার হয়ে গেলো সারা
সাথে তুষারের বাঁশি। সুন্দর ছিল সবকিছু। খুব আগে তো না। তিনমাস। এখন আর কিছুই আগের মত নেই। সব ফিকে হয়ে গেছে। কেউ হয়তো আছে তবু কেউ নেই।
হঠাত জমিরের কথা মনে পড়ে অনিকের। তাহলে কি সেও জমিরের মত? সেও কি বেঁচে দিচ্ছে কাউকে? অনিক দেখতে পায় দীপা হেঁটে আসছে। গাঢ় লাল রঙে ঢাকা ঠোঁটে সেই হাসি, আঁটসাঁট জামা, বুকে কামড়ের চিহ্ন। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় দীপা।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ক্রমশই বেড়েই চলছে সে কড়নাড়া।

গল্প আমাদের প্রাণের কথা বলে

গল্প আমাদের প্রাণের কথা বলে