প্রতিদিনকার মত আজকেও বিভিন্ন ধরনের, গড়নের, বর্ণের নরম তুলতুলে মাংশ পিন্ডগুলো বিভিন্ন আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় ক্রেতা আকর্ষণ করার এক তীব্র প্রতোযোগীতায় অবতীর্ণ। ওরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে-রাস্তা দিয়ে ইতস্তত সঞ্চরণশীল ক্রেতার যৌন উত্তেজনা বাড়িয়ে নিজের দেহটাকে বিক্রি করতে চায়। ক্রেতারাও কম যায় না-- বেঁছে বেঁছে ভাল, কচি, টাটকা, মোলায়েম, মোহন জিনিসটি ওদের চাই। বেচা-কেনার বিরাম নেই এখানে, দেনা-পাওনা-- শরীর বিনিময় টাকা। বিক্রেতাদের মাঝে অদ্ভুত এক প্রতিযোগীতা, ক্রেতারাই শুধু অনেকটাই ধীর; টিপে দেখে, চেখে স্বাদ নিয়ে তারপর সিদ্ধান্তে আসে। ক্রেতাদের সামনে বিকল্প অনেক, সিদ্ধান্ত নিতে সময় নেয়; মাছের বাজারের মত-কেউ পছন্দ করে ছোট মাছ, কেউ কেনে চর্বিওয়ালা, বেশীরভাগ ভালবাসে বিশাল পুচ্ছওয়ালা,
অনেকে চিকন পুচ্ছ, কেউ বা গোল মুখের, কিছুজন আবার লম্বা মুখ। কালো মাছ বিক্রেতাদের দিকে তেমন কেউ তাকিয়েও দেখেনা কিন্তু এদের হাক-ডাক অন্যদের তুলনায় একটু বেশী, কুইয়া মাছদের গা থেকে পচা গন্ধ আসে বলে ওদিকটা কেউ মাড়ায় না, সাদা মাছদের ওখানে ক্রেতার হট্টগোল অনেক বেশী হলেও লাল মাছের কদর অনেক-খুব একটা পাওয়া যায়না এখানে, দুই একটা পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশী পড়ে যায়-সংরক্ষিত থাকে বড় বড় ক্রেতাদের জন্য। বিক্রেতাদের অবিরাম প্রচেষ্টা দারুন ভাবে চোখে লাগে; কেউ সফল হচ্ছে আবার অনেকেই ব্যর্থ, যদিও ব্যর্থতায় ওরা কাবু হয়না; নতুন উদ্যমে, নবীন আশায় আবার আরেকজন খদ্দের টার্গেট করে। ওদের অধ্যবসায় দেখলে আইনস্টাইন পর্যন্ত লজ্জা পাবেন, কোন দিক দিয়েই ধৈর্যের কোন ঘাটতি নেই, চেষ্টা অবিরত, অফুরন্ত উদ্যম, সফলকাম হতেই হবে; কারন মাছ বিক্রি করেই যে, মাছের আদার জোগাড় করতে হয়।যারা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খদ্দের ডাকে তারা অধিকাংশই দেখতে খারাপ এবং বয়স্ক, পুরুষের শরীর-মনে কোন ধরনের আবেদনই তাদের দ্বারা তৈরী হয় না। আসল জিনিস সব পল্লীর ভেতর-অনেকেই দেখতে খুব সুন্দর ও আবেদনময়ী, প্রয়োজন হয়না কাউকে ডাকতে, ক্রেতারাই ওদের খুঁজে খুঁজে বের করে, ঘরে নিয়ে খিল মারে। অহংকারে ওদের খড়ের পালার মত স্তনজোড়া ফুলে-দুলে উঠে। আর যারা সুন্দর না বা যাদের আবেদনময়তা কালের পরিক্রমায় ইতিমধ্যেই শুন্যের কোঠায় তাদের বেচা-বিক্রি একদম বন্ধ, না খেয়ে মরার জোগাড়। ঘন্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বুক উন্মীলিত করে তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকাডাকি করে, খদ্দেররা ফিরেও তাকায় না; আর্তচিৎকারে আকাশে শ্যাওলা জমে, বাতাসে মরচেরা গভীর হয়।
আমি আর সোহেল রিক্সা থেকে নেমে নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা করতে করতে পল্লীর ভেতরে ঢুকে পড়ি। ভেতরে গলি রাস্তার ধারে, দোকানের সামনে বেশ্যা মাগীদের হাঁকডাক শোনা যায়ঃ হাই সেক্সি, অই লাল সার্ট, হেই লুঙ্গি পড়া, ঐ লম্বু, অরে আমার মোটকুরে, আহারে চিকনা কতদিন খাওনা, আরে বাইট্যা আসো আসো-অসংখ্য নিত্য-নতুন সম্বোধন। ওদের কাছে চেনা মানুষরাও অচেনা আর অচেনাদেরও প্রথম দেখাতেই আপন করে নিতে পারে। প্রথম আসার আভা যাদের মুখে দেখা যায় তাদের হাত মুচড়ে ধরে, বুকের কাপড় ফেলে সুডৌল ইশারায় নিজেদের আকর্ষণ বাড়ায়, পরিচিত মুখ পেলে কাঁধে-পিঠে স্তন আলতো করে ধরে আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকে, খদ্দেররা অবাক হয়ে দেখে রং-বেরঙ্গের হাসি কিভাবে ঝর্ণার পানির মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মন ভিজিয়ে দিতে চায়। মুখে এমনভাবে ঝামটা মারে যেন অনেকেই মনে করে ঘরের বউ-এরাও বউ তবে ক্ষনিকের এবং ঘরের না বাইরের। এরা মাঝে মাঝে এমন গালিগালাজ শুরু করে যা–ভদ্র সমাজে অশ্রাব্য, কিন্তু এখানকার পরিবেশ এতেই বরঞ্চ অনেক বেশী মোহনীয় এবং তরঙ্গায়িত হয়ে উঠে।
আমরা দুই বন্ধু গলি রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছি, অনুসন্ধিৎসু চোখ চতুর্দিক নিরীক্ষণ করছে এক ধরনের জারক তৎপড়তায়। চলার পথে অনেকেই সার্ট ধরে টানা টানি করে হাঁটার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, যদিও দুইজন দেখে খুব বেশী কাছে ঘেঁষতে সাহস পাচ্ছেনা; আর আমরাও সাথেই সাথেই চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছি। চোখের রঙ দেখেই বুঝতে পারে কে নতুন কে পুরাতন-নতুন হলে কোন কথা নেই ঝাপটে ধরে রুমে নিয়ে যাবে- পুরাতন বুঝতে পারলে রসময় আলোচনা জুড়ে দেবে।
আমরা দুই বন্ধু গলি রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছি, অনুসন্ধিৎসু চোখ চতুর্দিক নিরীক্ষণ করছে এক ধরনের জারক তৎপড়তায়। চলার পথে অনেকেই সার্ট ধরে টানা টানি করে হাঁটার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, যদিও দুইজন দেখে খুব বেশী কাছে ঘেঁষতে সাহস পাচ্ছেনা; আর আমরাও সাথেই সাথেই চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছি। চোখের রঙ দেখেই বুঝতে পারে কে নতুন কে পুরাতন-নতুন হলে কোন কথা নেই ঝাপটে ধরে রুমে নিয়ে যাবে- পুরাতন বুঝতে পারলে রসময় আলোচনা জুড়ে দেবে।
ডাবের নরম শাঁসের মত একটিও তীব্র আবেদনময়ী কচি কোন মেয়ে চোখে পড়ছেনা, মনে হয় আরো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে কারন ছোট ছোট কচি মেয়েরা সব সুনির্দিষ্ট একটি জায়গায় থাকে, ওদের কদর বেশী, বুড়ো হাবলাদের মত যেখানে সেখানে পড়ে থাকেনা। অনেক অলি-গলি খুঁজে তবেই ওদেরকে খুঁজে বের করতে হয়-টাটকা জিনিস পেতে হলে একটু কষ্টতো করতেই হবে!
সোহেলের আবার পছন্দ আঠার বিশ বছরের পূর্ণ যুবতী নারী । চলতে চলতে হঠাৎ করে টের পাই সে আমার সাথে নেই, পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখি; একটি মেয়ের সাথে দরদামে প্রচন্ড ব্যাস্ত। মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দর ও আবেদনময়ী, একনজর দেখলেই একটু চেখে দেখতে ইচ্ছা করে। আমার পছন্দ যেহেতু কচি মেয়ে- ঐ মেয়েটির দিকে তাই আমার চোখ যায়নি। সোহেল ঠিকই খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলেছে। মেয়েটি তিনশ টাকা দর হাঁকছে আর সোহেল দুইশ টাকার উপরে কোনমতেই উঠবেনা, কিন্তু মেয়েটিকে ওর বেশ মনে ধরেছে বলেই মনে হল-স্বাদ না নিয়ে ছাড়বেনা। বেশ কিছুক্ষণ দর কষা-কষির পর, সোহেল মেয়েটিকে বগলদাবা করে রুমের ভেতরে চলে গেলো। যাওয়ার সময় পিছন ফিরে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললঃ তোর জন্য বটতলায় অপেক্ষা করবো; তাড়াতাড়ি কাজ(কাম) সেরে চলে আসিস।
অগত্যা আমি একাই সামনের দিকে এগোতে থাকি। লাল-নীল, সাদা-কালো মাংশপিন্ড গুলো মৌমাছির মত ছেকে ধরল একা পেয়ে। দুটি মেয়ে দুদিক থেকে এসে আমার হাত দুটি ধরে ফেলল, কয়েকটি মেয়ে চেপে ধরে সার্টের কোনা, অবশেষে দশ-বারোজন বিভিন্ন আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় হেঁটে এসে পথ আগলে ধরল। আমার চোখ রাঙ্গানিতে ওদের কোন ভ্রুক্ষেপ হচ্ছে না ধমকে কোন ফল হবে বলে মনে হয়না। তখন দুজন ছিলাম তাই কাছে ঘেঁষতে খুব একটা সাহস পায় নি, এখন একা পেয়ে ছাই দিয়ে চেপে ধরেছে। দেখতে দেখতে ওরা আমাকে ঘেরাও করে ফেলল, এই মুহূর্তে যেকোন একজনের রুমে আমাকে যেতেই হবে কিন্তু আমার কাউকে পছন্দ হচ্ছেনা আর এরা কেউ কচি ডাবের মতো কোমল না-আমি এখন কি করব! অসহায়, নিরুপায় হয়ে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকি। হাঁটু দুটো পরস্পর ঘর্ষিত হতে থাকে, দাঁতে দাঁত লেগে শব্দ হয় ঠক ঠক ঠক--।
সামান্য একটু দূর থেকে একটি কর্কশ গলার স্বর আমার কর্ণকুহরে এসে প্রবেশ করে। “অই তরা ছেড়াডারে অমন কইর্যা চাইপ্যা ধরছস কেন”? বেশ্যা বইল্যা তগোরে কি কোন লজ্জা শরম নাই, পানের সাথে চিবায়্যা খাইয়্যা ফালাইছস নাকি? ছাড় অহনি ছাইড়্যা দে কইলাম; বলতে বলতে একজন বয়স্ক যৌন কর্মী এগিয়ে আসে। আমি একটু আস্বস্ত হই, বোধ করতে থাকি সামান্য নিরাপত্তা। অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করি, এইমাত্র শকুনী রূপধরা মেয়েগুলো সুবোধ বালিকাদের মত আমাকে ছেড়ে দিয়ে একে একে যার যার জায়গায় ফিরে গেলো। সে এসেই পরম নির্ভারতায় আমার হাত দুটি চেপে ধরে। মনে হল বাঘের তাড়া খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে কোন আপনজনের কোলে চলে এসেছি।
অগত্যা আমি একাই সামনের দিকে এগোতে থাকি। লাল-নীল, সাদা-কালো মাংশপিন্ড গুলো মৌমাছির মত ছেকে ধরল একা পেয়ে। দুটি মেয়ে দুদিক থেকে এসে আমার হাত দুটি ধরে ফেলল, কয়েকটি মেয়ে চেপে ধরে সার্টের কোনা, অবশেষে দশ-বারোজন বিভিন্ন আবেদনময়ী ভঙ্গিমায় হেঁটে এসে পথ আগলে ধরল। আমার চোখ রাঙ্গানিতে ওদের কোন ভ্রুক্ষেপ হচ্ছে না ধমকে কোন ফল হবে বলে মনে হয়না। তখন দুজন ছিলাম তাই কাছে ঘেঁষতে খুব একটা সাহস পায় নি, এখন একা পেয়ে ছাই দিয়ে চেপে ধরেছে। দেখতে দেখতে ওরা আমাকে ঘেরাও করে ফেলল, এই মুহূর্তে যেকোন একজনের রুমে আমাকে যেতেই হবে কিন্তু আমার কাউকে পছন্দ হচ্ছেনা আর এরা কেউ কচি ডাবের মতো কোমল না-আমি এখন কি করব! অসহায়, নিরুপায় হয়ে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকি। হাঁটু দুটো পরস্পর ঘর্ষিত হতে থাকে, দাঁতে দাঁত লেগে শব্দ হয় ঠক ঠক ঠক--।
সামান্য একটু দূর থেকে একটি কর্কশ গলার স্বর আমার কর্ণকুহরে এসে প্রবেশ করে। “অই তরা ছেড়াডারে অমন কইর্যা চাইপ্যা ধরছস কেন”? বেশ্যা বইল্যা তগোরে কি কোন লজ্জা শরম নাই, পানের সাথে চিবায়্যা খাইয়্যা ফালাইছস নাকি? ছাড় অহনি ছাইড়্যা দে কইলাম; বলতে বলতে একজন বয়স্ক যৌন কর্মী এগিয়ে আসে। আমি একটু আস্বস্ত হই, বোধ করতে থাকি সামান্য নিরাপত্তা। অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করি, এইমাত্র শকুনী রূপধরা মেয়েগুলো সুবোধ বালিকাদের মত আমাকে ছেড়ে দিয়ে একে একে যার যার জায়গায় ফিরে গেলো। সে এসেই পরম নির্ভারতায় আমার হাত দুটি চেপে ধরে। মনে হল বাঘের তাড়া খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে কোন আপনজনের কোলে চলে এসেছি।
যৌনকর্মীটির বয়স আমার কাছে বছর পয়ত্রিশের মত মনে হল, গাল দুটো বসে গেছে, তাতে মেছতার দাগ সুস্পষ্ট, সিগারেট খেয়ে খেয়ে মোটা ঠোঁট দুটো কালচে হয়ে গিয়েছে। চিবানো পানের লালরস বেরিয়ে আসছে যেন ঠোঁটের কোন বেয়ে রক্ত পড়ছে! দাঁতগুলো পান খেতে খেতে ফ্যাকাশে লাল, চোখদুটো শান্ত ধূসর, একধরনের অস্থিরতা-অসহায়ত্ব চোখের উপর ভর করে রয়েছে। চোখের নীচে কালি, কপালে হালকা সূক্ষ্ম বলি রেখা কেবল পড়তে শুরু করেছে, সামনের দিকের কয়েকগুচ্ছ চুল পেকে ধোঁয়াটে সাদা, স্তন দুটি অনেকটাই ঝুলে পড়েছে; ও দুটোকে কাচুলি দিয়ে বেঁধে টানটান রাখার একটি ব্যার্থ প্রয়াস। কোন পুরুষকে কাছে টানার সমস্ত যোগ্যতা যেন ইতিমধ্যেই হারিয়ে বসেছে। শুধু মাত্র তার সমস্ত শরীর দিয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে একটি ক্ষীন প্রভা বাৎসল্য রস।
সে আমার মাথায়-পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলতে থাকে - আমার নাম রোজিনা , আমারে তুই রোজিনা আফা বইল্যা ডাকবি। আর তর নাম কিরে ভাই?
মাথা নিচ দিকে দিয়ে, বিড়বিড় করে বলি –“নীরব”। আমি আর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারিনি-একটি লজ্জাবোধ পেটের ভেতর থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উপরের দিকে উঠে কন্ঠনালীটি রোধ করে দেয়।
রোজিনা আপা হৃদয়ের ঝরে পড়া আবেগ কথার সাথে মিশিয়ে বলতে থাকে, জানস নীরব আমি তহন অনেক ছোট, বয়স তের কি চৌদ্দ অবো, আমার ফুটফুটা ছোট একটা ভাই অইছিলো। ও দেখতে কি যে সুন্দর আছিলো, বড় বড় চোখে আমার দিকে কেমন কইর্যা যে তাকাইয়্যা থাকত আর খালি খিল খিল কইর্যা হাসতো! অর দাঁত ছাড়া মুখের হাসি শুইন্যা আমার বুকে সুখের কাঁপন লাগত খালি। একটুর জন্যে চোখের আড়াল অইলেই আমি অস্থির অইয়া যাইতাম, খালি পাগলের মত লাগত, বুকের মইধ্যে ডরাস ডরাস করতো। মায় তালুকদার বাড়িতে ঝিয়ের কাম করত, বাড়ীর হগগল কাম হারতো, আমি বেবাক সোম আমার আদরের ছোট্ট ভাইডারে কোলে কইর্যা রাখতাম। মায় খালি দুধ দেওনের সোম অর কাছে আইতো। আমার সোনার ছোট্ট ভাইডারে কোলে পিঠে নিয়া, হাইস্যা, খেইল্যা আমার দিন বালাই চইল্যা যাইতাছিলো।
একদিন আমার এক দুলাভাই আমাগো বাড়িতে আইয়া মায়-বাপের লগে অনেকক্ষণ ধইর্যা কথা কয়। হেয় নাকি আমারে টাংগাইল শহরে বড় লোকের বাসায় কাম দিব, কাম অইলো সাহেব-ম্যাডাম যহন অফিসে থাকবো তহন খালি হেগো বাচ্চা পোলাডারে কোলে কইর্যা রাখতে অইবো। হুইনা আমার মায়-বাপে তো খুব খুশি, পারলে তো তহনি দুলাভাইয়ের লগে দিয়া দেয় । দুলাভাই কইয়া গেল, এক হপ্তা পরে আইয়া আমারে নিয়া যাবো।
এক হপ্তা পরে বিকালে হেই লোকটা আইল আমারে নিয়া যাইতে। আমি শহরে যামু কত কিছু দেখমু, বড়লোকের বাসায় কত বালামন্দ খামু, রঙ্গীন টেলিভিশনে সিনেমা দেখমু, নাটক দেখমু, গান হুনমু। আমার ইচ্ছা অইতাছিল উড়াল দিয়া চইল্যা যাই । খালি আমার ভাইডার লাইগ্যা খারাপ লাগতাছিলো। যাওনের সময় আদরের ভাইডা, আমার দিকে বড় বড় চোখ কইর্যা তাকাইয়্যা আছিলো, তয় আর ডর কি দুলাভাই তো কইছে হপ্তায় একদিন আইয়া আমার ভাইরে দেইখ্যা যাবার পারমু ।
ঐ পরথম বাস গাড়ীতে উঠলাম, আমার ছোট্ট বুকটা ভয়ে ঢিপ ঢিপ করতাছিলো, তয় বালাও লাগতাছিলো। দুলা-ভাই আমারে শহরের কোনায় একটা বস্তিতে নিয়া গেল, বস্তির মানুষগুলান আমার দিকে কেমুন কেমুন কইর্যা জানি তাকাইতেছিলো, কেউ আমার সাথে একটা কথাও কয় নাই, আমি তহনও কিছুই বুইঝ্যা উডবার পারিনাইরে--। দুলাভাই আমারে একটা ঘরে নিয়া গিয়া হোটেল থিক্যা মাংশ ভাত আইন্যা খাওয়াইল। তারপরে জরুরী কাজের কতা কইয়া বাইরে চইল্যা গেল। আমার একা-একা খালি ডর লাগতাছিল, মনে কইতাছিল দুলাভাই আইলেই আমার সব ডর কাইট্যা যাব। হ – দুলাভাই আমার সব ডর কাটাইয়া দিছিলো। দুলাভাই আইলো, বাংলা মদ খাইয়া মাতাল অইয়া, যহন হগগলেই ঘুমাইয়া পড়ছে । তর সামনে কইতে শরম লাগে, দুলাভাই আইয়াই জোর কইর্যা আমারে কাম করলো, কাচা রক্তে বিছানা বাইস্যা গেছিলোগা। সকালে এহানে আইন্যা খালার কাছে বেইচ্যা দিল, তারপর থিকা এহানেই আছি, হগগলে যেমন থাহে। আমার ভাইডা অহন মনে অয় তর হুমান অইছে, খালি তারে দেকতে ইচ্ছা করে আর কাউরে দেকতে ইচ্ছা করেনা-মায়রেও না বাপরেও না, অর কতাই খালি বারে বারে মনে অয়। অরে দেহার ভাগ্য কোন দিন মনে অয় আমার অইবনা!
তারপর রোজিনা আপা, আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, আয় আমার ঘরে যাই, আমার ভাই মনে কইর্যা তরে একটু প্রাণ ভইর্যা দেহি।
আমি পুরোপুরি সম্মোহিত হয়ে গেছি, ছোট বাচ্চা যেমন করে তার আদরের পোষা ছাগলটিকে দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যায়, তেমনি রোজিনা আপা আমার হাত ধরে টেনে তার ঘরের ভেতর নিয়ে গেল।
ঘরটি অনেক ছোট, ভেতরে তেমন কোন আসবাব পত্র নেই, ছোট চৌকিতে বিছানাটি পরিপাটি করে সাজানো, বড় বড় লাল গোলাপ ছাপা পরিচ্ছন্ন বিছানার চাদর, পাশাপাশি রাখা দুটি বালিশ, পাশেই একটি ওয়ারড্রব; তার উপরে একটি সাউন্ডবক্স এবং একটি সিডি প্লেয়ার ও চৌদ্দ ইঞ্চি একটি রঙ্গীন টেলিভিশন পাশাপাশি রাখা। ঘরের কোনে ছোট একটি টেবিলের উপরে একটি পানি রাখার জগ, একটি কাচের গ্লাশ ও একটি মেলামাইনের প্লেট।
ঘরের ভিতরে গিয়ে আমি আস্তে করে বিছানার উপর বসলাম। রোজিনা আপা ঘরে ঢুকেই সুইচে চাপ দিয়ে বৈদ্যুতিক পাখাটা চালিয়ে দিল। সূর্যের আলো ছোট জানালাটি দিয়ে প্রবেশ করে ঘরটিকে বেশ আলোকিত করে রেখেছে। আমি নিজের মধ্যে ডুবেছিলাম, খট করে একটি শব্দ হতেই তাকিয়ে দেখি রোজিনা আপা দরজাটা খিল এটে বন্ধ করে দিচ্ছে। সে যখন পাশ ফিরে আমার দিকে তাকিয়েছে, তখন তার মুখের কান্না-কান্না ভাবটি পুরোপুরি বদলে গেছে। রোজিনা আপা এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে-চোখ দুটো সরু, মুখের মধ্যে একটি অনুজ্জ্বল কাম ভাব একটু ভয়ঙ্করতার দিকে বাক নিয়েছে যেন! সামনের পাটির লালচে দাঁত দিয়ে নিচের কালো ঠোঁটটিকে কামড়ে ধরে আলগোছে বুকের কাপড়টি ফেলে দেয়; মাঝাটা ঈষৎ বাঁকা, সরু ঘাড়টি একদিকে খানিকটা কাঁত হয়ে আছে।
তার মুখের রূপ আমূল বদলে গেছে, অভিনয়ে অনেকবেশী দক্ষতা না থাকলে এরকমটি হওয়া বেশ কঠিন। আমি যেন বনের ভেতর বাঘের দাবড়ানি থেকে কোনমতে রেহাই পেয়ে একেবারে কুলুপ আটা হায়েনার গর্তে এসে আটকা পড়েছি-এবারে আর রেহাই নেই, এখানে কেউ আসবেনা আমাকে বাঁচাতে। সোহেলকে ফোন করবো সেই আশাও নেই, কেঁড়ে নিয়ে যেতে পারে আশংকায় মোবাইল ফোনটি বাসায় রেখে এসেছি। বাংলা প্রবাদটির ঠিক উল্টো যেন আমার ক্ষেত্রে ঘটে চলেছে-বার আসান তের মুশকিল বা তারও বেশি! আমাকে এখান থেকে রক্ষা করতে পারে এমন কাউকে আমি হৃদয়ে মনে কোথাও কল্পনা করতে পারছিনা। আমার যেন অন্তিম দশা উপস্থিত হয়েছে!
রোজিনা আপা আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে কর্কশ গলায় অনেকটা ফিস ফিস করে বললঃ দে ট্যাহা দে, দুই-শ ট্যাহা দে অহনি।
টাকার বড়ই যন্ত্রনা, আমি শুধু বলতে পারলামঃ কেন, টাকা দেবো কেন?
সে আমার মুখের উপর আঙ্গুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল, দেখ কথা বাড়াবিনা, এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে; যা কই তাই কর। তুই আর আমি যে ঘরে ঢুকছি তা খালা দেইখ্যা ফালাইছে। ঘর থেকে বাইর অইলেই হেয় আমার কাছে ট্যাহা চাইবো, তা তুই ট্যাহা না দিলে আমি তারে কি জবাব দিমু? ক, ক দেহি?
টাকার বড়ই যন্ত্রনা, আমি শুধু বলতে পারলামঃ কেন, টাকা দেবো কেন?
সে আমার মুখের উপর আঙ্গুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল, দেখ কথা বাড়াবিনা, এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে; যা কই তাই কর। তুই আর আমি যে ঘরে ঢুকছি তা খালা দেইখ্যা ফালাইছে। ঘর থেকে বাইর অইলেই হেয় আমার কাছে ট্যাহা চাইবো, তা তুই ট্যাহা না দিলে আমি তারে কি জবাব দিমু? ক, ক দেহি?
আমি ভয় পাওয়া গলায় পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি আমাকে ছোট ভাইয়ের কথা বলে ঘরে নিয়ে এসে এরকম ব্যাবহার করছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে?
সে মুখে ঝামটা মেরে বলল, অ্যাঁ-- খুব সাধু সেজেছিস তাই না, ঠিক-বেঠিকের হিসাব শিখাস নাকি আমারে, এহানে কেন আইছস ক--, ধর্ম বোন বানাইতে নাকি কাম করতে? এহানে যারা আহে হগগলেই কাম করতেই আহে আর আমরা কাম করতে দিয়া ট্যাহা নেই।
আমি মনে মনে বুঝতে পারলাম, কিছু টাকা দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে নইলে সামনে ঘোর বিপদ! কিন্তু আমি তখন কি বুঝতে পেরেছিলাম টাকা দিয়েও আমি রেহাই পাবোনা, আমার সামনে আরো বিপদ অপেক্ষা করে আছে।
আমি কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম, আমার কাছে মাত্র এক-শ দশ টাকা আছে। দশ টাকা রিক্সা ভাড়ার জন্যে রেখে, বাকী একশ টাকা আপনাকে দিতে পারি।
সে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললঃ দে এক-শ ট্যাহাই দে, জলদি কর, দেরী করিসনা আমার আরো কাস্টমার ধরতে অইবো; তরে কোলে নিয়া বইয়া থাইক্যা আমার কুন লাভ নাই।
আমি পকেট হাতড়ে এক-শ টাকার নোটটি বের করে তার হাতে দিলে, সে নোটটি ভাজ করে ব্লাউজের নিচে রেখে দেয়। আমি মনে মনে বলি, এই যাত্রায় বেঁচে গেছি কিন্তু সে এক ঝটকায় আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে কনডমের একটি সিঙ্গেল প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললঃ এইডা পইর্যা লক্ষী ছেলের মত কাম কর নইলে খারাপ অসুখ বিসুখ অবো। দেহিস দুলাভাইয়ের মত আবার রক্ত বাইর কইর্যা ফালাইসনা। রোজিনা আপার মুখে মুচকি মুচকি বাঁকা হাসি খেলে বেড়াচ্ছে।
আমি মুখের মধ্যে একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে বললামঃ আমি আপনার সাথে এই কাজ করতে পারবোনা। টাকা চেয়েছিলেন দিয়েছি, এখন আমাকে যেতে দিন দয়া করে।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি হঠাতই সেটি রীতিমত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। এরকম মারাত্বক নারীমূর্তি এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না, ভয়ে আমার হৃদপিন্ড পাকিয়ে যেতে থাকে; পুরো মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আমি তখনও ভাবতে পারিনি আরো ভয়ঙ্কর কিছু আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
তার চোখ মুখে আগুন গলার স্বরে ক্রুদ্ধতা, কাম তরে করতেই অইবো, নইলে এহান থাইক্যা যাইতে পারবিনা।
আমি প্রতিউত্তরে ক্ষীণ কণ্ঠে ‘না’ বলতেই সে আবার ওয়ারড্রবের দিকে দৌড়ে যায়, ড্রয়ারের ভেতর থেকে বের করে আনে চকচকে ধারালো একটি ছুরি।
আমার জিহ্বা শুকিয়ে যায়, হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়, কে যেন বুকের ভেতরে বসে ড্রাম বাজাচ্ছে! ফুল স্পীড পাখার নিচে বসেও সমস্ত শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ছুটে আসে।
সে আমার দিকে ছুরিটি বাগিয়ে ধরে রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে; কাম তরে করতেই অইব, নইলে ছুড়িডা তর পেটের ভিতরে ঢুকাইয়া দিমু।
এরকম পরিস্থিতিতে পড়েও মনকে বোঝানোর চেষ্টা করি, সে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে মাত্র, এত বড় সাহস হয়তো সে কখনই পাবেনা।
আমি বলি, পারবনা-আপনার সাথে কাজ করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে; আপনি যা ইচ্ছা করতে পারেন আমাকে-মেরে ফেললেও সম্ভব না।
হঠাৎ সে ছুরিটি ফেলে দিয়ে দু-হাত দিয়ে মুখটি চেপে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে, সেই কান্না মেকী ছিল কিনা জানিনা। আমি পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেছি ততক্ষণে। আমার হতভম্ব হওয়ার তখনো আরো বাকী ছিল। মুখ থেকে হাতটি সরিয়ে সে যখন সকরুনভাবে আমার দিকে তাকালো তখন দেখতে পেলাম তার চোখ দুটো পান খাওয়া দাঁতের মতই ঘোলাটে লাল । মোটা কালো ঠোঁট দুটো তির- তির করে কাঁপছে।
ততক্ষণে আমি উঠে দাড়িয়েছি, সে একশ টাকার নোট খানি ব্লাউজের নিচ থেকে বের করে আমার হাতে দিয়ে, তারপর দরজার খিল খুলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আবার খিল লাগিয়ে দিল।
ইতিমধ্যেই আমার নড়াচড়ার শক্তি সম্পূর্ণভাবে লোপ পেয়েছে, ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে না দিলে আমি সম্ভবত বের হতেই পারতাম না। আমি স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে গেছে কিছুই স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিনা, কোন শব্দ ঢুকছেনা কান দিয়ে ভোঁভোঁ একটানা একঘেয়ে শব্দ ছাড়া। কোন ভয়ানক জাদুকর আমাকে যেন আলিফ-লায়লার জগতের পাথরের মূর্তিতে বদলে দিয়েছে। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি তা বোঝার বোধটুকুও হা্রিয়ে ফেলেছি। আস্তে আস্তে যখন কিছুটা অনুভূতি ফিরে পেলাম, তখন বুঝতে পারলাম ফুপিয়ে কান্নার একটি সকরুন সুর ধীরে ধীরে আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে। মনে হল কে যেন আমার কানের ভেতর গলিত সীসা ঢেলে দিচ্ছে। আমার পুরো মুখ গহ্বর একটি অব্যক্ত তিক্ততায় ভরে উঠেছে, একজোড়া সজল চোখের ফোটা ফোটা নোনা জল গড়িয়ে গড়িয়ে এসে আমার জিহ্বার উপর পড়ছে যেন!