আগুন যুদ্ধ

৩০ তম বিসিএসের রেজাল্ট শীটে নিজের রোল খুঁজে পেলাম নাঅথচ তিনবারের ম্যাট্রিক পাশ রঞ্জু ভাই চান্স পেয়ে গেল আর পাবেই না কেন! তার যে আছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাবা মুক্তিযোদ্ধা কোটার কথা শুনলে রেগে আগুন হয়ে যান কারণ একটাই, আমাদের সরকার গুলো নামে মাত্র মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করেছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বড় অংশ আজ রয়ে গেছে পদার আড়ালে আমাদের রঞ্জু ভাইয়ের বাপ বারেক মল্লিক অত্র এলাকার নাম করা মুক্তিযোদ্ধা বাবার মুখেই শুনেছি মুক্তিযোদ্ধা বারেকের গল্প
সুন্দরবনের গাঁ ঘেষা আমাদের শান্ত গ্রাম মুক্তিযুদ্ধকে এলাকার সাধারণ মানুষ বলত গন্ডগোল গন্ডগোলের বছর হিন্দুরা ইন্ডিয়া উঠে গেল যাওয়ার সময় কেন জানিনা বড় রাস্তা কেটে রেখে গেল জোয়ারের সময় নদীর পানিতে তলিয়ে থাকত বিল খাল আব্বা তখন ক্লাস সেভেন পড়ত বড় চাচা কলেজে পড়তেন দেশের বাতাসে তখন মুক্তির ঘ্রাণ কাউকে কিছু না জানিয়ে বড় চাচা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে সাতক্ষীরার বডার হয়ে ভারতে চলে গেলেন দাদী কেঁদে কেটে আঁচল ভিজিয়ে ফেললেন জীবন তো আর বাংলা সিনেমা না দাদীজানের কাছে তার ছেলেই বড় শেখ সাহেব নাকি ভুট্টো দেশের রাজা হবে এতে তার কিছু যায় আসেনা

বারেক চাচা শান্তি বাহিনীর হেড তার fড়িতেই পাক বাহিনী আস্তানা গেঁড়েছে দাদীর কান্না থেকেই ক্রমে ক্রমে বড় চাচার যুদ্ধে যাওয়ার খবর রাষ্ট হয়ে গেল ঘরে খাবার চাল ছিলনাগোলা ভরা ধান ছিলধান তো আর খাওয়া যায়না বাবাকে সাথে নিয়ে দাদা গেলেন ধান ভানাতে রাস্তার ওপাশে ছিল দাদাজানের ধান কল দাদাজান মিল স্টাট দিল, বাবা হলারে ধান ঢেলে দিল গোলপাতার চালের উপর চালতা গাছটায় কুটুম পাখি ডেকে উঠল আর সেই সাথে বারেক মল্লিকের গলা খাঁকারির শব্দ শোনা গেলআমি বুটের শব্দে কেঁপে উঠল আমাদের বাড়ির বাতাস খ্যাঁক খ্যাঁক করে বেল্লিকের মত হাসতে লাগল বারেক মল্লিক দাদাজান কে বলল, “তুমি মিয়া পাকিস্তানের শত্রু নিজের পোলাডারে পাঠাইছো নাছারাদের কাছে এই পবিত্র দ্যাশটারে শ্যাষ কত্তি তুমি মিয়া ইসলামের শত্তুর

পাকদের দিকে ফিরে বলল, “ ইয়ে আদমি গাদ্দার হে, উনকো লাড়কা মুক্তিমে যোগ দিয়া
পাক সেনাদের নিষ্ঠুর বুটের লাথি আছড়ে পড়ল দাদাজানের বুকে ধান কল ভেঙ্গে পাশের খালে ফেলে দিল বাবা আর দাদাকে লাথিতে লাথিতে রক্তাক্ত করে ফেলল পাগলীনির মত ছুটে এল দাদীজান দাদীজানের চুলের মুঠি ধরে আটকে রাখল এক পাক সেনা ঘরে, ধানের গোলায় আগুন দিলপূড়ে সব খাঁক হয়ে গেল গোলার ধান ফুতে খই হতে থাকল বেয়নেটের খোঁচায় নিস্তেজ দাদাজান ম্লান চোখে চেয়ে থাকল আগুনের দিকেবুটের লাথিতে আব্বার পা ভেঙ্গে গেছে সে ধান কলের খোলেনে পরে কাঁতরাচ্ছে দাদীজান কে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পাকিদের ডেড়ার দিকেরাত নামে এল আমাদের ভিটের উপর, চালতা গাছের ছায়ায়, ঘরের আগুন তখনো জ্বলছে, মনের আগুন কি কখনো নেভে!
দাদীজান আর ফিরে আসেনি, অসুস্থ দাদাজান আরো কয়েকটা বছর বেঁচে ছিলেননয় মাস পর দেশ স্বাধীন হয়ে গেল দাদজানের কথায় শেখ মুজিবের রাজত্ব শুরু হল যুদ্ধ শেষে কত মানুষ ফিরে এল আমাদের বড় চাচা থেকে গেল না ফেরাদের দলে
যুদ্ধের কয়েকটা বছর পর মল্লিক নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেওয়া শুরু করল একখান সাটিফিকেটও যোগাড় করে ফেলল আস্তে আস্তে তার রাজাকার পরিচয় মুছে গেলবতমান সরকার বাহাদুর ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি নাতনীরা এখন থেকে কোতা পাবেহয়তো মল্লিকের ওই সাটিফিকেট খানা নিয়ে রঞ্জু ভাইয়ের সন্তানেরা আমার সন্তানদের পিছে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবে তার থেকে কি ভাল না যে কোন সাটিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধার মেয়েকে বিয়ে করা যাতে আমার সন্তানেরা আর পিছিয়ে না পড়ে

সরকার বাহাদুর, তোমরা বারবার ক্ষমতায় আসার পথ পরিষ্কার করতে এই কোটা দাও কিন্তু আর কতকাল এভাবে চলবে আমার চাচার রক্তে গড়া এই দেশে মেধার অবমুল্যায়ন হবেতোমাদের রাজত্বের জন্য কি জীবন দিয়েছে আমার চাচারা!মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা দেওয়া অবশ্যই ভালো একটা উদ্যোগ কিন্তু এর তো একটা শেষ সীমা থাকা চাই


বারেক মল্লিকের মা এখনো বেঁচে আছে সহজ সরল গ্রাম্য মহিলা বারেক মল্লিক যে শান্তি বাহিনীর প্রধান ছিল একথা সে মাঝে মাঝে গল্পের মাঝে বলে ফেলে চালতা গাছের নিছে এখনো সন্ধ্যার ছায়া নামে, ঘরের আগুন নিভে গেছে সেই কবে কিন্তু মনের আগুন যে নেভেনা

গল্প আমাদের প্রাণের কথা বলে

গল্প আমাদের প্রাণের কথা বলে